শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৩ পূর্বাহ্ন

‘একটা পয়সাও হাতে নেই, চারদিন ধরে শুধু পানি খেয়ে বেঁচে আছি’

‘একটা পয়সাও হাতে নেই, চারদিন ধরে শুধু পানি খেয়ে বেঁচে আছি’

‘রোববার কারফিউ লাগার আগের দিন মালিক কিছু টাকা দিয়েছিল। তা দিয়ে তিন চার দিন খেয়েছি। তারপর থেকে আমরা কয়েকশো বাঙালী শ্রমিক শুধু নলের পানি খেয়ে থাকছি। একটাও পয়সা নেই হাতে। কোনও মতে পেটে গামছা বেঁধে রয়েছি। সবাইকে মিনতি করছি, একটু আমাদের কথাটা ভাবুন,’ বলছিলেন গুজরাটের সুরাট শহরে কাজ করতে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের এক শ্রমিক মুহম্মদ সেকেন্দার শেখ।

মাস তিনেক হল পূর্ব বর্ধমান থেকে সুরাটে এম্ব্রয়ডারির কাজ করতে গেছেন মি. শেখ। ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে যখন লকডাউন চলছে, তার মধ্যেই এক মানবিক সঙ্কটের দিকে দেশটি এগোচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। দিল্লি, মুম্বাই, গুজরাট বা দক্ষিণ ভারতে কাজ করতে যাওয়া কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক সেইসব জায়গায় আটকে পড়েছেন। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি তাদের আর্থিক অনুদান এবং খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও সেসব সাহায্য তাদের কাছে এখনও পৌঁছায়নি।

সপ্তাহান্তে দিল্লির একটি আন্তরাজ্য বাস টার্মিনালের ছবি বহু মানুষই দেখেছেন — কয়েক লক্ষ মানুষের ভিড় সেখানে, লকডাউনের পরে তারা নিজের নিজের গ্রামে ফেরার চেষ্টা করছেন। বহু মানুষ পায়ে হেঁটেই পাঁচ, ছয় বা সাতশো কিলোমিটার দূরে নিজের গ্রামে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছেন স্ত্রী সন্তানদের হাত ধরে। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন যে এই কয়েক লক্ষ মানুষ নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে গিয়ে সারা দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেবেন।

কিন্তু তারা বাধ্য হচ্ছিলেন পায়ে হেঁটে শয়ে শয়ে কিলোমিটার পাড়ি দিতে – কারণ এদের কাজ বন্ধ, তাই খাবারের সংস্থান অনিশ্চিত। গ্রামে ফিরলে অন্তত ঘরভাড়া গুনতে হবে না, আর কোনও মতে খাবার ঠিকই জুটে যাবে – এমনটাই ভেবেছিলেন এরা। যদিও দিন কয়েক পরে সরকার ওইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের দিল্লি ত্যাগ আটকাতে পেরেছেন। তবে লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই অনেকে ফিরে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে।

চেন্নাইতে কাজ করতে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার একদল শ্রমিক। সারা দেশে লকডাউন হয়ে যেতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা করে ২২ তারিখের জনতা কারফিউয়ের আগেই তারা ট্রেন ধরেছিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। কোনও মতে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন, কিন্তু যেহেতু ভিন রাজ্য থেকে এসেছেন, তাই ডাক্তার তাদের বাড়িতেই কোয়ারেন্টিনে থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন।

‘আমাদের বাড়ির অবস্থা এমন নয় যে আলাদা ঘরে থাকতে পারব। আবার এই পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষ বা পরিবারের অন্যদের কোনও বিপদ হোক তাও চাই নি। তাই গ্রামের বাইরে একটা বড় গাছে মাচা বেঁধে আমরা সাতজন থাকছিলাম। দিন ছয়েক ওইভাবেই ছিলাম। গ্রাম থেকে খাবার দিয়ে যেত। সংবাদ প্রচার হতে সরকারি কর্মকর্তারা জানতে পারেন। তারা এখন একটা শিশু বিকাশ কেন্দ্রতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পানি, খাবার – সব সরকারই দিচ্ছে,’ বলছিলেন দিন ছয়েক মাচা বেঁধে গাছের ওপরে আশ্রয় নেওয় এক পরিযায়ী শ্রমিক বিজয় সিং লায়া।

ব্যাঙ্গালোরেও কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের বহু নারীও সেখানে গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করেন।

ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা মিজ রোজি, যিনি শুধুই তার নাম ব্যবহার করেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গবেষণা করেন। সেই সূত্রেই পরিযায়ী শ্রমিকেদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে।

মিজ রোজি জানাচ্ছিলেন,‘প্রতিদিন আমাদের কাছে ৮০ থেকে ১০০-রও বেশি ফোন আসছে। সবাই বলছে তাদের হাতে পয়সা নেই, খাবার নেই, এমনকি জল কেনারও পয়সা নেই। অনেক জায়গাতেই জল কিনে খেতে হয়। যারা গৃহকর্মে যুক্ত আছেন, সেই সব নারী যেখানে কাজ করেন, সেখানে গিয়ে বেতন আনতে পারছেন না। আবার যারা নির্মান কাজে যুক্ত, তাদের নির্মানস্থলেই অস্থায়ী ছাউনি বানিয়ে রাখা হয়। লকডাউনের ফলে এরা সকলেই আটকে পড়েছেন।’

মিজ রোজি এবং আরও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সরকারি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন – শ্রমিক মহল্লাগুলিতে খাবার পাঠানোর জন্য। সারা দেশেই কয়েক লক্ষ শ্রমিক এই লকডাউনের ফলে আটকে রয়েছেন। খুব কম মানুষই আগে বাড়ি চলে আসতে পেরেছিলেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে গিয়ে একটা বড় মানবিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সলিডারিটি নামের একটি সংগঠনের নেতা রাতুল ব্যানার্জী।

‘সরকার বলেছে ঠিকই যে এদের কাছে আর্থিক অনুদান, খাদ্যশস্য পৌঁছানো হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কীভাবে হবে, তার কোনও দিশা কিন্তু এখনও নেই। আমাদের নেটওয়ার্কের সবার কাছে অসংখ্য ফোন আসছে, ফেসবুকে পোস্ট করছেন অনেকে নিজেদের দুরবস্থা জানিয়ে। আমরা সেই সব এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সেই বার্তা পৌঁছিয়ে দিচ্ছি।’

ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে পায়ে হেঁটে কয়েকশো কিলোমিটার পাড়ি দিতে গিয়ে ইতিমধ্যেই দু’জন মারা গেছেন।

মি. ব্যানার্জীর মতো সামাজিক কর্মকর্তারা বলছেন দ্রুত যদি এই শ্রেণীর মানুষের কাছে খাবার, খাবার পানীয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা আর কিছু অর্থ সাহায্য না পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে এরা রাস্তায় বেরোতে বাধ্য হবেন খাবারের খোঁজে, আর তখন লকডাউনের মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877